‘আলালের ঘরের দুলালে’র নায়ক চরিত্র: মতিলাল না বাবুরাম

পূজা দাস ‌এম.‌এ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)


        

“আলালের ঘরের দুলালে’র মধ্যেই সর্বপ্রথম বাংলা সাহিত্যে পূর্ণাঙ্গ চরিত্র সৃষ্টির সার্থকতা লাভ করিয়াছে।”
(আশুতোষ ভট্টাচার্য: বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাস)।

      সকল শিল্পের‌ই মূল লক্ষ্য হল মানব জীবনের সার্বিক সত্যকে প্রকাশ করা। উপন্যাস‌ও যেহেতু একটি শিল্পের‌ই রূপ এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। আর এই জীবনের সত্যতার রূপায়ণ ঘটে চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে। সেই কারণে উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে এক বা একাধিক মনুষ্য চরিত্র, সেই চরিত্র আমাদের চারপাশের টুকরো টুকরো চরিত্র নয়, তা হল অখন্ড ও অভিজাত মনুষ্য চরিত্র। একজন মানুষ তার জীবনের নানা কর্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন, তিনি হয়তো বেঁচে থাকেন দীর্ঘদিন কিন্তু তিনি চিরকাল স্থায়ী নন। অপরদিকে উপন্যাসিকের কাছে তাঁর জীবনের নির্বাচিত অংশ যখন উপন্যাসে অবলম্বিত হয়, তখন তাকে আর খন্ডিত করা যায় না। উপন্যাস মানব জীবনের সমস্যাকে তুলে ধরে ; এর জন্য চরিত্রের প্রয়োজন হয়। প্যারীচাঁদ মিত্র ‘আলালের ঘরে দুলাল’ উপন্যাসেও বিভিন্ন ধরনের চরিত্র সমন্বয় এবং সমস্যাকে তুলে ধরেছেন। একদিকে রয়েছেন–বেনীবাবু, বরোদাপ্রসাদ, বেচারামবাবু, রামলালের মতো খুব ভালো আদর্শ চরিত্র। এবং অন্য আর একপ্রান্তে রয়েছে – হলধর, গদাধর, বাঞ্ছারাম, দোলগোবিন্দ এবং ঠকচাচার মত খারাপ মানুষেরা। যাইহোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় হল – নায়কত্বের প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ উপন্যাসের নায়ক হিসাবে আমরা কাকে চিহ্নিত করতে পারি মতিলাল নাকি বাবুরাম?

■ ‘আলালের ঘরে দুলাল’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু :
         উপন্যাসটি শুরু হয়েছে বৈদ্যবাটির বাবুরাম বাবুর পরিচয় এবং অর্থ সম্পত্তির আলোচনার মাধ্যমে। তিনি কিভাবে নিজের সম্পত্তি গুছিয়েছেন তার বর্ণনা আছে। এমনকি টাকার জন্য হেনো কাজ নেই যা তিনি করেন না। এই ধনী বিষয়ী বাবুরামের অতি আদরের পুত্র মতিলাল আবাল্য কখনো ধর্ম নীতির শিক্ষা পাইনি। শিক্ষা ব্যাপারেও তার পিতা ছিলেন উদাসীন। তিনি মনে করেন টাকা দিয়েই ক্ষমতা দেখিয়ে তার পুত্র পুঁথিগতভাবে বিদ্যা লাভ করে শিক্ষিত হয়ে উঠবে। প্রথম প্রথম বিদ্যা অভ্যাস করতে গিয়ে গুরু মশাইকে আঁচড়ে কামড়ে দেয়, ফারসি পড়তে গিয়ে মুনসির দাড়িতে জ্বলন্ত টিকা দিয়ে পালিয়ে যায়। এরকম অনেক খারাপ কাজ করার পরেও, মতিলালের এমন দৌরাত্ম্যে বাবুরাম তাকে তো শাসন করেই না উল্টে তার হয়েই কথা বলে। অবশেষে ইংরেজি শিক্ষার জন্য মতিলালকে বালিতে বেনিবাবুর বাড়িতে পাঠানো হয় কিন্তু সেখানেও তার অত্যাচারে প্রায় প্রতি বাড়িতে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানেও তার অত্যাচারে পাড়া প্রতিবেশী ও স্বয়ং বেনিবাবু  বিরক্ত হয়ে নিঃসন্তান বেচারাম বাবুর বাড়িতে মতিলালের থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখানে তার সাথে যুক্ত হয় বেচারাম বাবুর দুই মাতৃপিতৃহীন বকে যাওয়া ভাগ্নে। এদের সঙ্গে মিশে সে আরও অধঃপাতে যায়। কুসঙ্গ ও কুকর্মের ফলে মতিলালকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এই সংবাদে বাবুরাম তার ছেলেকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে ঠকচাচাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় উপস্থিত হন। সেখানে মিথ্যা সাক্ষীর মাধ্যমে তত্ত্ব তদ্বির করে মতিলালকে পুলিশের হাত থেকে উদ্ধার করা হয়। জেলে যাওয়ার পরও মতিলালের স্বভাবের কোন পরিবর্তন হয় না। বরং পিতা মাতার অত্যাধিক আদরে সে আরও ভীষণ দৌরাত্ম্য ও দুরাচারী হয়ে ওঠে। এমনকি পথ চলতি মেয়েরাও তার হাত থেকে রেহাই পায় না। অবশেষে মাধববাবুর কন্যার সঙ্গে মতিলালের বিয়ে হয়। উপন্যাসের ঠিক উল্টোদিকে বরদাবাবুর সান্নিধ্যে রামবাবুর ছোটছেলে রামলাল সৎচরিত্র, ন্যায়পরায়ণ, এবং সত্যনিষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে বিষয়ের রক্ষাকল্পে রামবাবু মতিলাল ও রামলালের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে। ঠিক তখনই  তাতে ঘি ঢালে ঠকচাচা। ঠকচাচার পরামর্শে ও সকলের অমতে রামবাবু আবার দ্বিতীয় বিবাহ করেন। বিয়ের কিছু দিন না যেতেই অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান। এর ফলে রামবাবুর সমস্ত সম্পত্তির ভার বড় ছেলে মতিলালের উপর ন্যস্ত হয়। ঠকচাচা ও বাঞ্ছারামের কু-পরামর্শে সে তার ভাই, বোন, মা সবাইকে ত্যাগ করে। অতিরিক্ত বাবুয়ানিতে তার সমস্ত সম্পত্তি শেষ হয়ে যায়। অবশেষে আঘাতে, অর্থাভাবে বাবুয়ানার খোলস হারিয়ে মতিলালের চেতনা ফেরে।  তারপর কাশিতে এক সাধুর সান্নিধ্যে এসে পাপমুক্ত জীবন ধারন করার সংকল্প নেয়। শেষে মা, ভাই, ভগিনী সবাইকে ফিরিয়ে এনে একসাথে আবার তারা সুখের সংসার করতে থাকে।

‘আলালের ঘরে দুলাল’ উপন‍্যাসের মতিলালের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য:
         কোনো কাহিনি বা উপন্যাসে কখনো কখনো দেখা যায় মন্দ একটা চরিত্র হঠাৎ কোনো কারণে খুব ভালো হয়ে যায় এবং বাকি জীবনটা সে ভালো মানুষ হিসেবে কাটিয়ে দেয়। আর এর‌ই এক জ্বলন্ত উদাহরণ আমরা জানতে পারি ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসের মতিলাল চরিত্রের মাধ্যমে। এখানে আমরা মতিলালের চরিত্র কতগুলি বৈশিষ্ট্য পায়—
ক. অবাধ্য জেদি মতিলাল : উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখি, বৈদ্যবাটির রামবাবুর ছেলে মতিলাল ছোট থেকেই অতি যত্নে ও আদরে মানুষ হয়েছে। আর তার আদর যত্ন এতই অধিক ছিল যে সে হয়ে ওঠে সকলের অবাধ্য আর জেদি প্রকৃতির। কার‌ো কথা শোনা তো দূরে থাক, সে যা মনে করত তাই করতো,— “…কখনো বলিত – বাবা চাঁদ ধরিব– কখনো বলিত বাবা তোপ খাবো।” এসব না পাওয়ায় যখন চিৎকার করে কান্না করত তখন প্রতিবেশী লোকজন বলত– “ঐ বান ছেলেটার জ্বালায় ঘুমানো ভার।” এমনকি বাবা আমার অশ্কারা পেয়ে পড়াশোনা করার কথা তো অনেক দূরের বিষয়, পাঠশালায় যাবার নামও করত না। অনেক কষ্ট যদিও বা যেত তাও গুরু মশাইরা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠত।

খ. কটুভাষী মতিলাল : ছোট থেকেই ধর্ম ও নীতি শিক্ষার অভাবে মতিলাল হয়ে উঠেছিল কটুভাষী। সে জানতো না তাকে কিভাবে সম্মান দেখাতে হয়, কিভাবে কথাবার্তা বলতে হয় গুরুজনদের সঙ্গে, এমনকি দম্ভের বশে জানার চেষ্টাও করত না। তাই সে পূজারী ব্রাহ্মণকে বলতে পারে,– “অরে বামুন, তুই যদি হ,য, ব, র, ল শিখাতেই আমার নিকট আর আসিস ঠাকুর ফেলে তোর চাউল- কলা পাইবার উপায় শুদ্ধ ঘুচাইয়া দিব।” এমনকি মুনসির কাছে ফারসি পড়তে গিয়ে তার দাড়িতে আগুন দিয়ে বলে – “কেমন রে ব্যাটা নেরে আমাকে পড়াবি?”

গ. চঞ্চল ও অত্যাচারী স্বভাবের মতিলাল: মতিলালের চরিত্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য তার স্বভাব ছিল অতি চঞ্চল। সে একদন্ড কোথাও ভালোভাবে বসে থাকত না। বালির বেনীবাবুর বাড়িতে নতুন এসেও তার স্বভাবের কোন পরিবর্তন হয়নি।  ঔপন্যাসিকের উক্তিতে –”এক স্থানে কিছুকাল বসিতে তাহার দারুন ক্লেশ বোধ হয়।”- তাই সে বেনীবাবুর  বাড়িতে প্রথম দিন এসেই চতুর্দিকে ‘দাঁদুড়ে’ বেড়াতে লাগল – কখনো ঢেঁকিতে পা দিচ্ছে, ছাদের উপর গিয়ে দুপ দাপ লাফাচ্ছে, রাস্তার লোকজনকে ইটপাটকেল মারছে, কারো বাগানের ফুল ছেঁড়ে, কারোর গাছের ফল পাড়ে, কারো মটকার উপর উঠে লাফায়, আবার কারো কলসি ভেঙে দেয়। মতিলালের অত্যাচারে বালির সমস্ত লোকের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তারা বলতে থাকে –”যেমন ঘর পোড়া দ্বারা লস্কা ছারখার হইয়াছিল আমাদিগের গ্রামটা সেরূপ তছনছ হবে নাকি?”

ঘ. আসামী মতিলাল :  মতিলালের দিন দিন কুস্বভাব ও কুমতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাছাড়া বেচারাম বাবুর বাড়িতে তার দুজন সঙ্গী জোটে হলধর ও গদাধর। এরা তার কুকর্মে আরও মদত দিতে থাকে, বলা যথার্থ সঙ্গী হয়ে ওঠে। অবশেষে জুয়া খেলার দায়ে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আসামী বানিয়ে দেয়। তবে অবশ্য রামবাবু ও ঠকচাচার মিথ্যে সাক্ষীর মাধ্যমে তাকে মুক্ত করে আনা হয় নিজের গৃহে। এত কিছুর পরেও তার শিক্ষা হয় না। দলবল নিয়ে সে ক্রমশ দুরাচারী হয়ে ওঠে। এমন কি পথচারী ভদ্রকন্যার প্রতি অভদ্র আচরণ করতেও দ্বিধা করেনি।

ঙ. সৎ সঙ্গে মতিলালের চিত্তশোধন :  “সদুপদেশ ও সৎসঙ্গে সুমতি জন্মে, কাহার অল্প বয়সে হয়– কাহার অধীক বয়সে হইয়া থাকে।” বিষয় কর্মে অনভিজ্ঞ মতিলাল পিতার মৃত্যুর পর ঠকচাচা ও বাঞ্ছারামের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে। ঠকচাচা ও বাঞ্ছারামের বুদ্ধিতে মতিলাল ব্যবসায় নেমে সর্বস্বান্ত হয়।  তারপর কর্মপদকহীন মতিলালকে তার সঙ্গীরা ত্যাগ করে। অর্থাভাবে সঙ্গীহীন হয়ে মতিলালের চিত্ত শোধন হয়। এরপরে পদব্রজে কাশীধামে রওনা হয়ে এক সাধুর সান্নিধ্যে তাঁর সৎ উপদেশ ও সঙ্গতার মনের কালিমা দূর করে। সে সর্বদা নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল – “আমার পরিত্রান কিরূপে হইতে পারে? আমি যে কুকর্ম করিয়াছি তাহা স্মরণ করিলে এখন হৃদয় দাবানলের ন্যায় জ্বলন্ত হইয়া ওঠে।” এভাবেই তার আচরণের পরিবর্তন আসে।

আলালের ঘরে দুলাল’ উপন‍্যাসেরবাবুরামের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য :
    উপন্যাসের প্রথমেই দেখতে পাওয়া যায় বৈদ্যবাটির জমিদার বাবুরামকে। যিনি অনেক টাকা সম্পত্তি করেছেন এবং টাকার জন্য এমন কোন কাজ নেই যা তিনি করতে পারেন না এখানে তার কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হল–
ক. স্নেহান্ধ পিতা :  বাবুরাম বাবুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তিনি পুত্রের স্নেহে অত্যন্ত অন্ধ ছিলেন। তিনি পুত্রকে এত বেশি স্নেহ করতেন যে, পুত্রের দোষ-গুণ কিছুই তিনি দেখতে পেতেন না। মতিলাল যখন মুনসির দাঁড়ি পুড়িয়ে দেয় তখন বাবুরাম নিজের ছেলেকে না শাসন করে, মুনসিকেই দোষারোপ করে এই বলেন –”মতিলাল তো আমার তেমন ছেলে নয়–সে বেটা জেতে নেড়ে– কত ভালো হবে?”

খ. স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত: বাবুরাম বাবুর অন্য একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো তিনি ছিলেন স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য থেকে জানা যায় –”আপনার স্ত্রীকে বড় ভালোবাসিতেন। স্ত্রী যাহা বলিতেন, সেই কথাই কথা–স্ত্রী যদি বলিতেন, এ জল নয় – দুধ, তবে চোখে দেখিলেও বলিতেন, তাই তো–”। এমন কি ঝড়ের মুখে পড়ে তখন নৌকা ডুবতে চলেছে তখনও তিনি স্ত্রীর মুখ মনে করে নিজের মধ্যে মনবল ফিরে পান। বাড়িতে পৌঁছাতে দেরি হবে জানিয়ে চিঠিও লিখেছেন। পুরো উপন্যাসে কোথাও তাদের বিবাহিত জীবনের কোন অসুখী ছবি ছবি পাওয়া যায় না।  

গ.বাবুরামের কার্পণ্য: জমিদার বাবুরাম বাবু প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হলেও তার অতুলনীয় কার্পণ্য লক্ষ্য করা যায়। মনে মনে ছেলের বিদ্যা শিক্ষার জন্য অদম্য ইচ্ছা থাকলেও টাকার মায়া তিনি ছাড়তে পারেননি। মতিলালের ইংরেজি শিক্ষাদানের জন্য যাতে অল্প খরচে কাজ মিটে যায়, তাই তিনি বালির বেনীবাবুর বাড়িতে মতিলালকে পাঠিয়ে দেন। বেনীবাবু যখন ২৫ টাকার বিনিময়ে মতিলালকে পড়ার কথা বলে তখন বাবুরাম বলে ওঠে– “যদি এত টাকা দিব তবে তোমার নিকট নৌকা ভাড়া করিয়া এলাম কেনো?”

ঘ. সংস্কারবাদী : বাবুরামের অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হল, তিনি হলেন সংস্কারবাদী। যেহেতু তিনি ছিলেন বলরাম ঠাকুরের সন্তান, তাই নিজের জাতি রক্ষার্থে –”কন্যাদ্বয় জন্মিবা মাত্র বিস্তর ব্যয় ভূষন করিয়া তাহাদের বিবাহ দিয়েছিলেন।”– তার ফলস্বরূপ যা ঘটেছিল বড় মেয়ে বাল্যবিবাহ এবং ছোট মেয়ে কুলীনের হাতে পড়ে অত্যাচারিত হয়। আর দুজনেই বাবার বাড়িতে পড়ে থাকতে হয়।

ঙ. অহংকারী ও দাম্ভিক:  বাবুরাম ছিল অহংকারী ও দাম্ভিক প্রকৃতির। আর হবেই না বা কেন? তিনি ছিলেন বিপুল ধন- সম্পত্তির মালিক, তাই ধন ও সম্পত্তির অহংকার তাকে দাম্ভিকে পরিণত করেছে। তার সবথেকে বড় অহংকারের বিষয় ছিল মতিলাল। নিজের ছেলেকে নিয়ে তিনি সবসময় অহংকারী হয়ে থাকতেন। যখন গুরু মশাই ছলনা করে মতিলালের কাগজ ও কলাপাত কেনার কথা বলেন তখন তিনি আহ্লাদের মগ্ন হয়ে বললেন – “না হবে কেন!সিংহের সন্তান কি কখনও শৃগাল হ‌ইতে পারে?”– এখানে তার অহংকার মনের‌ই প্রস্ফুটন ঘটেছে।
এছাড়াও তার চরিত্রের মধ্যে উঠে আসে তদানীন্তন বাবু চরিত্র, বিবাহের বাতিগ্রস্ত বুড়োর পরিচয়, ইংরেজদের তোষামোদে লিপ্ত আরো অর্থ সঞ্চয় চেষ্টা ইত্যাদি দিকগুলি।

  ■ দুটো চরিত্রের তুলনামূলক আলোচনা :

“যাঁরা চরিত্রের সময়ানুক্রমিক বিকাশ দেখাতে অভ্যস্ত বা সেভাবেই বিকাশ দেখতে চান, তাঁদের কাহিনীতে প্রথমে চরিত্রের ধারণা অস্পষ্ট রাখা হয়। পরে কাহিনীর মধ্যে ধীরে ধীরে তার পূর্ণ পরিচয় প্রকাশ পায়।”
(উজ্জ্বল কুমার মজুমদার)

এই ধারণা আমরা মতিলালের চরিত্র প্রসঙ্গে পেয়ে থাকি। আলালের প্রতিবেশ পূর্ণাঙ্গ ও তথ্যবহুল। জীবনের নানামুখীতাকে অবলম্বন করে ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসটি রচিত। এই উপন্যাসে কেবল রাস্তাঘাটের কর্ম-ব্যস্ততা ও শুধুমাত্র সজীব চাঞ্চল্যই নেই, আছে পারিবারিক জীবনের শান্ত ও দৃঢ় মূল কেন্দ্রিকতা, আইন-আদালতের কৌতূহল পূর্ণ কার্যপ্রণালী, নব প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ শাসনের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ব্যক্তিজীবনের গতি ছন্দকে নিয়ন্ত্রিত করে এসেছে– প্যারীচাঁদ তাঁর উপন্যাসে এই চিত্রকে সুপ্রকটভাবে তুলে ধরেছেন। “মানুষ যে ঘটনা প্রবাহে ভাসমান খড়কুটামাত্র নয়, তাহার ব্যক্তিত্ব যে নদী তরঙ্গ-প্রহত পর্বতের ন্যায় কম্পিত হইলেও স্থানভ্রষ্ট হয় নাই।” – বাবুরাম প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উক্তিটি যথার্থ মর্ম আছে।  বাবুরাম নিজে, তাহার গৃহিনী ও কন্যাদ্বয়- এরা সবাই ঘটনা প্রবাহে জলকনা মাত্র নয়, এরা হল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ‘বাবুর’ ন্যায় চর্মের ক্ষীন আবরনে ঢাকা কঙ্কাল। অপরদিকে মতিলালেরও আচরণের পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনের চিত্র ঔপন্যাসিকের দৃষ্টিতে – “…দুরাবস্থায় পড়িয়া ক্রমাগত একাকী চিন্তা করাতে তাহার মনের গতি বিভিন্ন হইতে লাগিল।” –মতিলালের যেমন দুষ্টু বুদ্ধি, বয়সেও তাই। সে বেশ বোকাটে এবং স্থূল স্ফূর্তি বাজ। তার পিতা বাবুরামের মতই সে ব্যক্তিত্বহীন। কিন্তু পিতার মতো অন্ধ স্নেহ তার নেই, নেই কোন হৃদয় বেগও। তার চরিত্রের এই পরিবর্তন, চারিত্রিক উন্নতির বীজ এই স্বভাবের মধ্যে ছিল না।

তার এই চরিত্র পরিবর্তনের দিকটি প্রতি লক্ষ্য রেখে শ্যামল কুমার সেনগুপ্ত মন্তব্য করেছেন – “তার নায়ক সত্তা চরিতার্থ হয়েছে এবং লেখকের উপন্যাস রচনাও সফল হয়েছে।”

সুতরাং মতিলালকে ঘিরেই উপন্যাসের উৎপত্তি, বিকাশ, এবং পরিণতি। তাই মতিলাল হল এই উপন্যাসের নায়ক। প্রথমের দিকে উপন্যাসটি বাবুরাম দ্বারা পরিচালিত হলেও, আদি, মধ্য, অন্ত্য লেখক যে কাহিনীর সৃষ্টি করেছেন সেই কাহিনীর নায়ক মতিলাল। সমকালীন বাস্তব জীবনের প্রতি যে প্রতিচ্ছবি মেলে মতিলাল এর মধ্যে। ধনীর দুলাল, বাবুগিরিতে মত্ত। এদিক দিয়ে দেখলে অসম্পূর্ণ হলেও মতিলালই প্রথম উপন্যাসোচিত নায়ক চরিত্র। আর প্যারীচাঁদের হাতেই বাংলা উপন্যাসের নায়ক চিন্তার শুভারম্ভ এই মতিলাল চরিত্রের মাধ্যমে।

জীবনকে অখন্ডভাবে ধারণ করার প্রেরণা তিনি অনুভব করেছিলেন। যা তাঁর আগে কেউ করেননি। এ কারণে তিনি প্রথম ঔপন্যাসিক।”(সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়)

      উনিশ শতকের বাংলা গদ্য সাহিত্যের শুভ লগ্নে উপন্যাস সৃষ্টিতে বা উদ্ভবের ইতিহাসে প্যারীচাঁদ মিত্রের নাম মনে রাখার মতো। তিনি ছিলেন ডিরোজিওর বিশেষ অনুগামী এবং ইয়ং বেঙ্গলের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তাঁর অবদান বাংলা সমাজ ও সাহিত্যে বিশেষভাবে স্মরণীয়। উপন্যাসটির নামকরণ থেকেই আমরা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে উপন্যাসের নায়ক কে হতে পারে? ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামের মধ্যে আমরা আলালের থেকে দুলালের নামের উপরই বেশি প্রভাব দেখতে পায়। তাই যদি আলাল এখানে বাবুরাম হন, তবে দুলাল এখানে নিশ্চয় মতিলাল। যে কিনা বাবুরামের প্রশ্রয়ে বকে গেছে। এই তথ্য থেকে আমরা একটি স্পষ্ট বুঝতে পারি, এই উপন্যাসের প্রকৃত নায়ক মতিলাল। তা ছাড়া উপন্যাসের শেষে মতিলালের যে আত্মদংশন আমরা লক্ষ্য করি –”আমি যা কুকর্ম করিয়াছি তাহা স্মরণ করিলে এখনো আমার হৃদয় দাবানলের মত জ্বলিয়া ওঠে।” – এই অনুভূতি মতিলালকে নায়ক পদে থেকে উন্নীত করতে এক ধাপ এগিয়ে দেয়। তবে অনেকেই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র ঠকচাচাকে নায়কের জায়গা দিতে চেয়েছেন কারণ উপন্যাসটির সমস্ত আবর্তন নির্ভর করেছে ঠক চাচার কার্যকলাপের উপর। এমন কি মতিলালের পিতা বাবুরাম বাবু যেমন ঠক চাচার বুদ্ধিতে পরিচালিত হয়েছেন, পরবর্তীকালে মতিলাল‌ও সেই পথাবলম্বী হয়েছে। তবুও মতিলালকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের সম্পূর্ণ কাহিনি উপস্থাপিত করেছেন ঔপন্যাসিক। মতিলালকে তিনি গড়ে তুলেছেন সমকালীন বাঙালির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হিসাবে। সর্বোপরি, শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহে তার শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে এবং সবাইকে ফিরে পেয়েছে। এর মাধ্যমে লেখক তাকে মানবিকতার উচ্চভূমিতে প্রচেষ্টা করেছেন। আর মতিলালকেই ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসের নায়ক চরিত্র হিসাবে হিসাবে বেছে নিতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয় না।