মনসামঙ্গল কাব‍্যে মনসা চরিত্র


ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে এক ধর্মবিষয়ক আখ্যান কাব্য রচিত হতে দেখা যায়, এই আখ্যান কাব্যগুলি ‘মঙ্গল কাব্য’ নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, যে কাব্য শ্রবণে মঙ্গল ও বিপরীত হলে অমঙ্গল, যে কাব্য মঙ্গলধার, এমন কি যে কাব্য ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয়ে থাকে তাকে বলা হয় ‘মঙ্গল কাব্য’।
মঙ্গলকাব্য উৎপত্তির নেপথ্যে যে কারণগুলো রয়েছে সেইগুলো হল –
১/ তুর্কি আক্রমণ: ক্ষেত্র প্রস্তুতির কাজ।
২/ তুর্কি আক্রমণোত্তর সমাজ: ধর্মের পরিমার্জন ও বিবর্তন।
৩/ হিন্দু সমাজের আত্মক্ষয় ও আত্মশুদ্ধি।
৪/ সাংস্কৃতিক অবনমন ও মুক্তির উপায়।
৫/ উচ্চ ও নিম্নবর্গের সামঞ্জস্য ও সহযোগিতা।
৬/ লোকায়ত জীবন ও সংস্কৃতির সমাবেশ।
৭/ ব্রাত্যের কান্না ও প্রত্যাঘাতের সাহস।
● লৌকিক দেব-দেবীকে অবলম্বন করে বহু কবিকে একই ধরনের আখ্যান রচনা করতে দেখা যায়। লৌকিক ধর্ম প্রভাবিত মঙ্গলকাব্যগুলি হল –
১/ শিবায়ন, ২/ মনসামঙ্গল ৩/ চণ্ডীমঙ্গল, ৪/ ধর্মমঙ্গল, ৫/ কালিকামঙ্গল – বিদ্যাসুন্দর, ৬/ শীতলা-মঙ্গল, ৭/ অন্নদামঙ্গল, ৮/ রায়-মঙ্গল, ৯/ ষষ্ঠীমঙ্গল, ১০/ সারদা-মঙ্গল, ১১/ সূর্য মঙ্গল।

মনসামঙ্গল কাব‍্যের কবি –
আমাদের আলোচ্য বিষয় ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের কবিদের সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় নেহাৎ কম সংখ্যা নয় মনসামঙ্গল কাব্যের কবি সংখ্যা।


১/ রাঢ় অঞ্চলে মনসা মঙ্গল কাব্য রচনায় যে সকল কবিদের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁরা হলেন – বিষ্ণুপাল, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ , বিপ্রদাস পিপিলাই।
২/ পূর্ববঙ্গের পদ্মাপুরাণ রচনায় যে সকল কবিদের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁরা হলেন – নারায়ণ দেব, বিজয় গুপ্ত , বংশীদাস।
৩/ উত্তরবঙ্গের মনসামঙ্গল রচনায় যে সকল কবিদের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁরা হলেন – তন্ত্রবিভূতি , জগজ্জীবন ঘোষাল, জীবনকৃষ্ণ মৈত্র।
পঞ্চদশ শতাব্দী- নারায়ণ দেব – পদ্মাপুরাণ, বিজয় গুপ্ত- পদ্মাপুরাণ, বিপ্রদাস পিপিলাই – মনসামঙ্গল / মনসাবিজয়।
ষোড়শ শতাব্দী – গঙ্গাদাস সেন- মনসামঙ্গল, রায় বিনোদ- মনসামঙ্গল।
সপ্তদশ শতাব্দী – কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ – মনসামঙ্গল, দ্বিজ বংশীদাস- পদ্মাপুরাণ , তন্ত্র বিভূতি – মনসামঙ্গল , মনসাপূরাণ।
অষ্টাদশ শতাব্দী – জগজ্জীবন ঘোষাল- মনসামঙ্গল,‌ ষষ্ঠীবর দত্ত-পদ্মাপূরাণ, জীবন মৈত্র – মনসামঙ্গল, দ্বিজ রসিক – মনসামঙ্গল, বিষ্ণুপাল – মনসামঙ্গল , বানেশ্বর রায় – মনসামঙ্গল ।

    

পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত দেবী মনসাকে কেন্দ্র করে বহুসংখ্যক মঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে। পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ সর্বত্রই মনসামঙ্গলের কাহিনী লোকায়ত জনসমাজে প্রচলিত। কাব্যগুলির মধ্যে ভৌগলিক অঞ্চল বিশেষে সামান্য পার্থক্য লক্ষ করা গেলেও তার গঠন রীতি একই রকম। দেবী মনসা নিম্নবর্গের কৌম সমাজে পূজিত দেবী ছিলেন সর্বপ্রথম প্রাগার্য যুগ থেকে তাঁর পূজার প্রচলন ছিল। পালযুগের সময় থেকে দেবী মনসা উচ্চবর্গে মর্যাদা পেতে শুরু করেছিলেন। বাংলার সর্পদেবী মনসার পরিকল্পনায় অনার্য সভ্যতার শক্তিপূজার প্রভাব লক্ষ করা যায়। মহাভারতের পরবর্তী যুগে দেখা যায় ভারতের প্রায় সর্বত্র সর্পকে পুরুষ দেবতা বাসুকি রূপে পূজা করার প্রচলন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ও দাক্ষিণাত্যে রূপটি ছিল ভিন্ন এখানে স্ত্রী দেবতা পূজার প্রচলন হয়েছিল। মনে করা হয় জলজঙ্গলে পরিবেষ্টিত মানুষ সর্পের ভয় থেকে বাঁচার জন্য মনসাপূজার প্রচলন করেছিলেন।

     মনসামঙ্গলের কাহিনীকে ভাগ করলে দুইটি ভাগ পাওয়া যায়। একটি দেবখণ্ড অন্যটি মর্ত্যখণ্ড। স্থান, কাল, পাত্রভেদে পার্থক্য দেখা গেলেও, এমনকি বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনায় সংক্ষেপণ, বিস্তৃতি গ্রহণ বর্জন সংযোজন দেখা গেলেও মনসামঙ্গলের একটি গতানুগতিক কাহিনী সব কবির কাব্যেই কম বেশি পাওয়া যায়।

মনসামঙ্গল কাব‍্যের মনসা চরিত্র –
    মনসামঙ্গল কাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন দেবী মনসা। ‘মনসামঙ্গল’ নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে আলোচ্য কাব্যটি দেবী মনসার মাহাত্ম নিয়ে রচিত। কাব্যের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মনসাদেবীর যে স্বরূপ লক্ষ করা গিয়েছে তাকে লৌকিকতার ছাপ স্পষ্ট। দেবী মনসার জন্ম নিয়ে বিভিন্ন কবি বিভিন্ন রকমের কথা বলেছেন। মনসার জন্ম যেন এক অলৌকিকতার আঁধারে আচ্ছন্ন। শিব যেহেতু পুরাণের একজন প্রধান দেবতা ফলে তার কন্যা হিসেবে মনসাকে দেখিয়ে কবিরা মনসাকে লৌকিক দেবী থেকে আর্য দেবীতে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি করেছেন।

    কাব্যে দেখা যায় শিব পুষ্পবনে ফুল তুলতে গেলে সেখানে শিবের দেখা হয় তাঁর অযোনী সম্ভূতা কন্যা মনসার সঙ্গে। শিব মনসাকে পেয়ে বাড়িতে অশান্তি হবে ভেবেও স্নেহ পরবশে মনসাকে বাড়ি নিয়ে যান। শিব তাঁর ফুলের ঝুড়ির মধ্যে মনসাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে শিব ক্লান্ত হয়ে গেলে বছাই নামক এক ‘হালুয়া’ চাষির বাড়িতে মনসাকে রাখেন। বছাই মনসাকে বিবাহ করতে চাইলে মনসা অসম্মত হলে, বছাই তাঁর প্রতি বল প্রয়োগ করে, যার ফলে মনসার বিষ দৃষ্টি বছাই-এর উপর পরে এবং তাঁর মৃত্যু ঘটে।–
“কোপকরি পদ্বাবতি চাএয়ার চৌকে।
ঢলিয়া পড়িল তবে পদ্দার সমুকে।”
ছেলের মৃত্যু দেখে বছাই-এর মা মনসার কাছে ছেলের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে মনসা বছাইকে জীবিত করে দেন। পূর্ব বঙ্গের কবিদের মনসা চরিত্রের এই বর্ণনা থেকে তাঁর স্বাভাবিক নারীস্বভাব, অন্যটি তাঁর প্রবল আত্মপরায়ণতা ও প্রতিহিংসা সাধন বৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
শিব মনসাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলে অন্যদিনের মতো তিনি ফুলের ঝুড়ি সামনে না রেখে আড়ালে রাখলে দেবী চণ্ডীর তা দেখে সন্দেহ হয় । দেবী চণ্ডী এই রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে মনসাকে দেখতে পান। মনসাকে চণ্ডী সপত্নী ভেবে অকথ্য ভাষায় তিরস্কার করার পাশাপাশি শারীরিক নির্যাতন করতেও পিছপা হননি –
“চুলে মুখে পেটে পিষ্টে মার ঘারকাতা।
বিপরীত বোলে পদ্মা মনে লাগে বেথা।।
নিষ্ঠুর হইয়া মারে চণ্ডী প্রাণে সইতে নারে।
বাপ বাপ বলি পদ্মা ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।।”
এমনকি মনসার একটি চোখ নষ্ট পর্যন্ত করে দেন-
“এত বলি কোপে চণ্ডী না করিল আন।
নখাঘাত করি বামচক্ষু কৈল কান॥”
প্রথমে মনসা নীরবে চণ্ডীর প্রহার সহ্য করলেও একটা সময় আসে, যখন মনসা প্রত্যাঘাত করতে বাধ্য হন, এবং মনসার বিষ দৃষ্টির কোপে চণ্ডী ঢলে পড়েন। কার্ত্তিক গনেশ শিব সহ দেবতারা চণ্ডীকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করতে থাকে, শেষে শিবের কথায় মনসা মন্ত্র পড়ে চণ্ডীকে বাঁচিয়ে দেন । ফলে বোঝাই যাচ্ছে চণ্ডী ও মনসা দুইজনই কর্তৃত্ব পরায়ণ ও প্রতিহিংসাপ্রবণ চরিত্র। দুইজন প্রতিদ্বন্দ্বী চরিত্রের একত্রে বসবাস করা সম্ভব নয় জন্য মনসাকে বাধ্য হয়ে বনবাসে যেতে হয়।
বনবাসে যাওয়াকালীন মনসা চরিত্রের তিন রকম স্বরূপের কথা জানা যায় কবিদের রচনা থেকে।
নির্বিচারে মনসা চণ্ডীর আদেশ শিরোধার্য করে পিতার সঙ্গে বনবাসে যাওয়ার সময় জন্মদাতা পিতা শিবকে মানবিক অধিকাররোধের অনুযোগে বাণ বিদ্ধ করে নিজের অসহায় অবস্থা ব্যক্ত করেছেন।–
“এতেক কহিলা যদি দেব ত্রিলোচন।
কান্দিতে লাগিয়া পদ্মা ধরিয়া চরণ॥
বাপ হইয়া বনে দিবা বল হেন বাণী।
কিরূপে রহিব আমি হইয়া একাকিনী॥”
◆দ্বিতীয় ধারায়, মনসা শিবের কাছে চণ্ডীর আদেশ রদ করার জন্য বৈঠক করলে অপরাগ শিব মনসাকে চণ্ডীর নিকট অনুরোধ জানাতে বলেন, মনসা তখন শিবের কথা মতো পূর্বের অপমান ভুলে চণ্ডীর নিকট ক্ষমা চান-
“এত সব দুঃখ পদ্মা বিসরিয়া মনে
পুনরপি ধরিলেক চণ্ডীর চরণে।”
তৃতীয় ধারায় দেখা যায়, ক্রুদ্ধা মনসা চণ্ডীকে বনবাসে যাওয়ার সময় কোন রকম অনুরোধ করেননি বরং সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।–
“ তবে সে আমার নাম মনসা – কুমারী। এই মনস্তাপ যদি শুনিবারে পারি।”

       তিনটি ধারার যে মনসা চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় তাতে বিজয় গুপ্ত ও তন্ত্রবিভূতির মনসা আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। তাঁদের মনসা চণ্ডীর কাছে লাঞ্ছিত হয়ে নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও কেন তাঁকে বনবাসে পাঠানো হবে তা জিজ্ঞাসা করেছেন। এই ধারায় মনসার ধারণা ছিল শিব যে পরিবারের কর্তা সে যখন নিষ্ক্রিয় হয়ে চণ্ডীকে কিছু বলছেন না তখন মনসা আর কি করবে, তখন মনসা বিনা বাক্যব্যয়ে চণ্ডীর আদেশ শিরোধার্য করে বনবাসে গেলেন। বিপ্রদাসের মনসা চরিত্রের মধ্যে তেমন আত্মমর্যাদা বোধ দেখা যায় না, তাঁর চরিত্রের মধ্যে অনেকটা নমনীয়তা লক্ষ করা যায়, এই কারণে শিবের কথা মতো মনসা চণ্ডীর কাছে এতো লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত হয়েও সেই সমস্ত ভুলে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতে কুন্ঠিত হননি। যদি মনসা চরিত্রের প্রবল প্রতিহিংসা পরায়ণতা এবং স্বার্থচেতনাকে চরিত্রের প্রবল প্রতিহিংসা পরায়ণতা এবং স্বার্থচেতনাকে চরিত্রের আদিবৃত্তির ধর্ম বলে ধরা হয় তাহলে বিপ্রদাস মনসা চরিত্রের মধ্যে সেই সকল বিষয় লক্ষ করা যায় না বরং মনে হয় সমাজের চাপে মনসা চরিত্র যেন নমনীয় হয়ে পরেছে। কাহিনীতে মনসার তৃতীয় যে স্বরূপটি পাই তাতে তাঁর হিংসাপরায়ণ রূপ লক্ষ করা যায়।‌ তিনটি রূপের মধ্যে প্রথম রূপটিই বলা যায় মনসা চরিত্রের আদি ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
      এরপর কাব্যে সমুদ্র মন্থনের প্রসঙ্গ আসে। সেই মন্থনে ওঠা বিষ পান করে শিব মূর্ছাপ্রাপ্ত হলে দেবতারা সকলে ও চণ্ডী হতবিহ্বল হয়ে কাঁদতে শুরু করেন, নারদের পরামর্শে মনসাকে বনবাস থেকে আনা হয়, মনসা তাঁদের কথায় পিতা শিবকে বাঁচিয়ে তোলেন।

     মনসার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ ছিল তাঁর বিবাহ। দেব সমাজে তাঁর পাত্র না পাওয়া গেলে নারদের পরামর্শে মনসার সঙ্গে এক ব্রহ্মচারী ও বিগত যৌবন মুনি জরুৎকারুর বিবাহ ঠিক হয়, কিন্তু মুনি জরুৎকারুর কোনো ইচ্ছে ছিল না মনসার প্রতি। তিনি মনসার সকল কামনাবাসনাকে প্রত্যাখ্যান করেন। মনসার মত পূর্ণযৌবনা ও উগ্রস্বভাবা নারী এতে সহজেই ক্রুদ্ধা হন, জরুৎকারু মনসাকে তারফলে চিরকালের জন্য ছেড়ে যান। এই ছেড়ে যাওয়ার সময় মনসার নারী হৃদয়ের যে বেদনা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে তার আলোচনা করলে দেখা যায়, বিজয় গুপ্তের রচনায় –
“ অপরাধ ক্ষমা কর রাখ রাঙা পারে।
স্ত্রীলোকের অপরাধ ক্ষমিত উঠিত হয়ে।।”
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের রচনায় পাওয়া যায় –
“কান্দিয়া কমলা কয়: শুন মুনি মহাশয়: আমারে ছাড়িয়া যাহ তুমি।
বিভা করি নিজ : তাহারে না কর দয়া: কি বুদ্ধি করিব তবে আমি।।”
বিজয় গুপ্ত, দ্বিজবংশীদাস ও কেতকাদাসের মনসার মধ্যে স্বামী ছেড়ে যাওয়ায় যতটা না কষ্ট দেখানো হয়েছে অন্যান্য কবিদের মনসা চরিত্র নির্মাণে সেই কষ্ট লক্ষ করা যায় না।
‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের প্রত্যেক কবিই জরৎকারুকে দিয়ে বরদান প্রথার মধ্য দিয়ে মনসার পুত্র হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করেছেন তাঁদের কাব্যে । বিপ্রদাস, তন্ত্রবিভূতি, জগজ্জীবন প্রমুখ কবিরা বিজয় গুপ্ত, দ্বিজবংশীদাস ও কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের তুলনায় ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন, তাঁদের ধারণার মধ্যে দেখা যায় বিয়ের উদ্দেশ্যই হল সন্তান লাভ, যেখানে নারী পুরুষের প্রকৃত হৃদয়গত ভালোবাসার স্থান নেই, এই কারণেই তাঁদের অঙ্কিত মনসা স্বামী চলে গেলেও সন্তান প্রাপ্তির বরে সন্তুষ্ট হয়েছেন। অন্যদিকে বিজয় গুপ্ত, দ্বিজবংশীদাস ও কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ প্রমুখ কবিদের মনসার হৃদয়গত সম্পর্ক ও নারীর সামাজিক সম্পর্কের উপর জোর দিতে দেখা গিয়েছে। এই কারণে তাঁর স্বামী চলে যাওয়ার কথাতে অজানা ভবিষ্যতের ভাবনায় ব্যাকুল হতে দেখা যায়। সুতরাং বলা যায় এই কবিদের সৃষ্ট মনসাচরিত্র পূর্বে কথিত কবিদের তুলনায় বেশি মানবিক ও অনুভূতি সম্পন্ন।

     এর পরবর্তীতে মনসার পূজা পাওয়ার কাহিনী লক্ষ করা যায়। মনসা স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নেমে এসে একে একে রাখাল বালক, জালু-মালু, হাসান-হুসেন প্রমুখদের কাছে পূজা লাভ করতে থাকে, কিন্তু এদের কাছে পূজা পেয়েও মনসা সেই ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারছিলেন না ফলে শেষে তিনি বনিক সমাজের শ্রেষ্ঠ বণিক চাঁদ সদাগরের কাছে যান পূজা পাওয়ার জন্য। কিন্তু পরম শৈব চাঁদ বণিক মনসার পূজা করতে চাননি । ফলে সেখান থেকে চাঁদ বণিক ও মনসার দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় । চাঁদ সদাগরের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সময় মনসার মধ্যে এক ভীষণ প্রতিহিংসা প্রবল এবং আত্মপরায়ণ শক্তিরূপের আত্মপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। মনসার দুইজন পরম প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন চণ্ডী ও চাঁদ সদাগর, চণ্ডীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে তিনি পরাজিত হয়ে বনবাসে দিনযাপন মেনে নিলেও চাঁদ সদাগরের কাছে তিনি পরাজিত না হওয়ার জন্য চাঁদ সদাগরের উপর প্রবল অত্যাচার করেন এবং তার ফলে চাঁদের উপর প্রতিপত্তি বিস্তারেও সক্ষম হন। চাঁদ সদাগরের উপর অত্যাচার স্বরূপ তাঁর ছয় পুত্রকে হত্যা করেন, বানিজ্য পাটনে চাঁদের উপর অমানবিক অত্যাচার করেন-
“চুলে  ধরিয়া তারে মারে বজ্র কিল৷”
গুয়াবাড়ি ধ্বংস করে দেন, নটীবেশে মহাজ্ঞান হরণ করেন –
“নটী রূপে পদ্মা গেলা চান্দরনগর।
সুললিত নাচে গায়ে অতি মনোহর।”
বিজয় গুপ্তের মনসার মধ্যে নটী রূপে চাঁদ সদাগরকে আকৃষ্ট করতে দেখা গেলেও তাঁর মনসা শুধু নৃত্য পটীয়সী, ছলনার কোনো লক্ষণ তার মধ্যে লক্ষ করা যায় না। অন্যদিকে বিপ্রদাসের মনসার মধ্যে দেখা  যায় তিনি ছলনায় পারদর্শী, তিনি ছলনায় পারদর্শী, তিনি রুনুঝুনু শব্দে যখন চাঁদের সামনে দিয়ে যান তখন আড়চোখে ও দেহের ছন্দে চাঁদকে মোহান্ধ করতে দেখা যায়। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসার মধ্যে দেখা যায় তিনি চূড়ান্ত বাক্ পটিয়সী। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের কবিদের মধ্যে দেখা যায় বারঙ্গনা বিলাস সম্পর্কে প্রাচীন কবিদের থেকে আধুনিক কবিরা বেশি নিখুঁত।
বিবাহের রাত্রে লখিন্দরের মৃত্যু ঘটানোর জন্য মনসা যে নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছেন তা মনুষ্যতর জীবকে হার মানিয়ে দেয়। লখিন্দরকে দংশন করার ব্যাপারে মনসার মধ্যে কোনো অনুশোচনা লক্ষ করা যায়না কিন্তু কালনাগিনীর মনে দ্বিধা লক্ষ করা যায় –
“ছকুড়ি নাগের মাতা এ কালনাগিনী।
তে কারণে হৃদয়েতে শোক দুঃখ জানি॥”
‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের কবিদের কাব্যে মনসার নির্মমতার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায় মনসা জীবনে কিছুই পাননি বলা যায়। পিতার স্নেহ, মাতার ভালোবাসা স্বামীর প্রেম সবকিছু থেকেই সে বঞ্চিত। কৈশোর জীবন থেকে তিনি পেয়েছেন শুধু পুরুষের নির্লজ্জ কামুকতার গন্ধ, বিমাতার লাঞ্ছনা, পিতার ঔদাসীন্য, প্রতারণা, স্বামীর বঞ্চনা। একজন রমণীর সুব্যক্তি গঠনের জন্য যেসকল উপাদান দরকার মনসার জন্য সেইগুলো ছিল দুর্লভ। এই কারণেই মনসার মধ্যে টিকে থাকার জন্য প্রত্যাঘাত করার মনোভাব দানা বেঁধেছে। নাহলে মনসার মধ্যেও আছে এক কোমল মন, উত্তরবঙ্গের ধারার কবিদের রচনাতে পাওয়া যায় মনসা চাঁদের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়ার আগে প্রীতির মারফৎই পূজা পেতে চেয়েছিলেন –
“পদ্মা বোল দাদা কত বাড়াইস দ্বন্দ্ব।
সভার ভিতরে কেনে বোল মন্দ ছন্দ॥
এখন আমাকে দাদা দেহ পুষ্পজল।
ঘরে ঘরে দ্বন্দ্ব বাদ নহিবে কুশল॥”

দেবী মনসা চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তিনি নিজেই নিজের পূজা প্রচার করেছেন এবং জনসমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি তাঁর ভক্তদের পরীক্ষা করে নিজের পূজাধিকার বিস্তৃত করতে জানেন এমনকি তিনি তাঁদের প্রতি যথেষ্ট সদয়ও হন। আজ বাংলার ঘরে ঘরে দেবী মনসা প্রতিষ্ঠিত, অনেক লোকাচার মেনে আজ মনসা পূজা পালন করা হয় ।