গণদেবতা উপন্যাসে অনিরুদ্ধের চরিত্র

পূজা দাস (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)


“কথাসাহিত্যে গণতান্ত্রিক চেতনা এসেছে সত্য, অতি নগণ্য মানুষ- বেকার মধ্যবিত্ত যুবক থেকে পথের ভিখারী, নগণ্য বস্তিবাসী, কুলি মজুর, সাহিত্যের বিষয় হয়েছে কথা ঠিক, কিন্তু কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকদের রচনায় সামাজিক পটভূমিতে এসব ব্যক্তির সমস্যা তেমন ফোটেনি, সমাজ নিরপেক্ষ ব্যক্তি কেন্দ্রিক কাহিনীই তাদের কল্পনাকে উদ্বেলিত করেছে।” (গোপিকা নাথ রায়)

কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ত্রয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় নিম্নবর্গের সমাজের চিত্র সুচারুভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। প্রাচীন যুগ থেকে সমাজ বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের সমাজ ব্যবস্থায় এসে পৌঁছেছে – সেই সমাজের দেহে ছিল বর্ণভেদ, শ্রেণীভেদ, জাতিভেদ, ধর্মভেদ, পেশাগত ভেদ, লিঙ্গভেদ প্রভৃতি ভেদরেখা। আর যার ফলে সমাজে জন্ম নিয়েছে- ডোম, মুচি, মেথর, ছুতোর, কামার, নাপিত, কৃষিজীবী শ্রেণীর মানুষদের মতো নিম্নবর্গস্থিত মানুষেরা। যাদেরকে আমরা আন্তেনীয় ভাষায় বলতে পারি ‘subaltren’. ত্রিশের দশকে সমাজের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিক অতিক্রম করে বাংলা কথাসাহিত্য ক্রম ক্রমশ সরে আসছিল তার চেনা ও নির্দেশিত পথ থেকে, আর এগিয়ে আসছিল তার বিপরীতে নিচু শ্রেণীর প্রান্তিক বাসিন্দা ও অচেনা আদিবাসী সমাজের দিকে। ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এই নবীন ধারায় তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি, বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর স্বাক্ষর রেখে বাংলা সাহিত্যে যশস্বী হয়ে আছেন। তারাশঙ্করের রচনায় নিম্নবর্গের মানুষেরা তাদের বিচিত্র সমস্যা নিয়ে ভীড় করে এসেছে তাঁর গল্প বা উপন্যাসে। শুধুমাত্র প্রসঙ্গ ক্রমেই নয়, নিম্নশ্রেণীর নিম্নবৃত্তের মানুষের সমস্যা, বিপর্যয়, শোষণ, বঞ্চনা, জুলুম প্রভৃতি অতি মর্মস্পর্শী ভাষায় সহৃদয়তার সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গল্প উপন্যাসে। আর সমস্ত মানুষগুলোর প্রতিও তাঁর ছিল অসাধারণ ক্ষমতা। তাঁর “গণদেবতা” উপন্যাসে অনিরুদ্ধ কামার ছিল এই নিম্নবর্গের‌ই অন্যতম প্রতীক।

‘গণদেবতা’ উপন্যাসটির সংক্ষিপ্ত কাহিনি ও চরিত্রটির পরিচয়:
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গণদেবতা’ উপন্যাসটি প্রথমে ধারাবাহিকভাবে ভারতবর্ষ পত্রিকায় ‘চন্ডীমণ্ডপ’ নামে প্রকাশিত হলেও, পরবর্তীকালে ১৩৪৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে ‘গণদেবতা’ নামাঙ্কিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটিকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সরোজকুমার রায়চৌধুরী মহাশয়কে। উপন্যাসটির কাহিনি গড়ে উঠেছে পাশাপাশি দুটি গ্রাম শিবপুর ও কালীপুর নিয়ে এবং গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের জীবনযাত্রাকে কেন্দ্র করে। শিবকালীপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিচু বংশের মানুষের বসবাস করে, যেমন- কামার, ছুতোর, বায়েন, নাপিত, ধোপা এবং পৈতৃক সূত্রে তারা তাদের বর্ন অনুযায়ী নির্দিষ্ট কাজগুলি করে। শিবকালীপুরের নীচু বংশের মানুষগুলো অবস্থাপন্ন  কৃষক এবং জমিদারদের হাতের পুতুল। তাদের নিজস্বতা বলে কিছু নেই। কামার লোহার জিনিস তৈরি করে দেয় ধানের বিনিময়ে ছুতোর, বায়েন, নাপিত প্রত্যেকে ধানের বিনিময়েই কাজ করে। কখনো ধান পায়, আর না পেলে বাকি পড়ে থাকে। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে বাংলায়। তাই মানুষ দেশী বহু দামি পণ্য ছেড়ে বিদেশি সস্তার পণ্যের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। ফলে অনিরুদ্ধ ও গিরীশ তাদের গ্রামের ব্যবসা উঠিয়ে দিয়ে শহরে গিয়ে দোকান তৈরি করেছে। তাতে গ্রামের কৃষকদের অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়। গ্রামের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে সভা করে। এই সভায় অনিরুদ্ধ স্পষ্ট ভাবে বলে দেয় যে, তারা গ্রামে কাজ করতে পারবেনা। ‘গণদেবতা’ উপন্যাস মূলত উঁচুবর্নের বিরুদ্ধে নীচুবর্ণের বিরুদ্ধতা বা প্রতিবাদ দেখা যায়। অনিরূদ্ধের দেখাদেখি গ্রামের পাতু বায়েন,  ধোপা ও নাপিত প্রভৃতি মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এর ফলে শ্রীহরির মতো জমিদার শ্রেণীর অত্যাচার বেড়ে চলে। আর এই অত্যাচারী শ্রেণীর বিরুদ্ধে এবং অত্যাচারিত শ্রেণীর সাপেক্ষে এসে দাঁড়ায় দেবু ঘোষ। এর পরে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। শেষে দেখা যায় জমিদারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য দেবু, অনিরুদ্ধ এবং যতীনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। শুধুমাত্র শ্রীহরের মতো জমিদারের চক্রান্তে এতগুলো জীবন যারা  হয়ে উঠতে পারত অন্য আলোকে, তারা ফুটে ওঠার আগেই নিভে গেল অন্ধকারের মধ্যে।

■ ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে অনিরুদ্ধ চরিত্রটির পরিচয়:

“গণদেবতা এক নায়কত্বের উপন্যাস নয় ইহা বহুনায়কত্বের উপন্যাস।”
(শেখ আহাসান কেরিম)


    গণদেবতা উপন্যাসে অনিরুদ্ধ, গিরীশ ও পাতুর মনে যে বিদ্রোহ তা হল উচ্চশ্রেনীর বিরুদ্ধে কামার, ছুতোর, নাপিতের বিদ্রোহ। অর্থাৎ পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর বিদ্রোহ। আর এই বিদ্রোহের উত্তেজনাপুর্ন আবহাওয়ায় যে চরিত্রগুলোর ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতা অর্জন করেছিল, তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম অনিরুদ্ধ কামার। উপন্যাসটি শুরু হয়েছে “সামান্য কারণেই গ্রামেএকটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল।” কারণটা ছিল অনিরুদ্ধ ও তার সঙ্গী গিরীশ কলকাতায় মফস্বলে: দোকান করেছে‌।  তার ফলে গ্রামের মানুষের অসুবিধা হয়, তাদের সুবিধার তারা অনিরুদ্ধার বিরুদ্ধে মজলিস ডাকে।  এখান থেকেই অনিরুদ্ধের যাত্রা শুরু। উপন্যাসে দেখা যায়, অনিরুদ্ধ একজন বিদ্রোহী প্রজা, তার এই বিদ্রোহ শুধু ছিরুপালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সেখান থেকে উঠে এসেছে ইউরোপে নবজাগরণের ফলে গ্রামীণ মানুষেরা সস্তা সুলভে জিনিস কিনত, তাই তাদের কাজ প্রায় বন্ধের পথে,  সেই ধণতন্ত্রের ওপরেও তার আক্রোশ ছিল। উপন্যাসে তার বিদ্রোহের মধ্যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ অনুকূল বাতাসে জ্বলে উঠেছে। আর এই আগুন সে তার সমস্ত সুখ- শান্তি, সামাজিকতা আত্মসম্মান সমস্ত আহুতি দিয়েছে।  উপন্যাস যত শেষের দিকে গেছে ততই অনিরুদ্ধের চরিত্রের অবনতি ঘটেছে- “অনিরুদ্ধ এখন সেই অনিরুদ্ধ নেই, এখন মাতাল,…”।  এমনকি সে কামাচারী দুর্গার কাছে যেতেও দ্বিধাবোধ করে না, এবং সেই সঙ্গে সে তার অন্ন গ্রহনও করে।  তার মুখ থেকে শুনতে পাওয়া যায় ভিটেমাটির প্রতি বিশেষ টানের কথা। সে নাম করা কামারের ছেলে ও নাতি হওয়ায় সে কুলির কাজ করতে পারবে না জানায়। তাই সে ঋন করে নতুন কর্মসূত্র খুঁজে পেলেও তা বেশী দিনের জন্য স্থায়ী হয়নি। পরে দেখা যায় ময়ূরাক্ষী তীরে বাগানবাড়ির আমগাছ কেটে জেলে যায় সে।  উপন্যাস শেষে তার অন্তর্ধান হয়ে যায়।

■ ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে অনিরুদ্ধ চরিত্রটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য: 
  গণদেবতা উপন্যাসে অসংখ্য মানুষের ভিড় আছে, তাদের মধ্যে ঔপন্যাসিক নীচুশ্রেণীর ও জমিদার শ্রেণীর মানুষদের তুলে ধরেছেন। নিচু সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই জমিদার উচ্চশ্রেণীর মানুষদের উপর বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে কামার অনিরুদ্ধের বিদ্রোহ সর্বপ্রথম  উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে।  উপন্যাসে অনিরুদ্ধ চরিত্রের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় –

◆ স্পষ্টবাদী:  অনিরুদ্ধ চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আমরা দেখতে পাই যে, সে স্পষ্টবাদী প্রকৃতির, সত্য কথা, মনের কথা বলতে সে দ্বিধা করে না। তাই তার শহরে কাজ করা নিয়ে যখন গ্রামের কৃষক ও জমিদার সবাই একত্র হয়ে তার বিরুদ্ধে সভা বসায়, সেই সভায় সে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, “আমরা আর ‌ও কাজ করব না মশায়। জবাব দিলাম।”  এখানে সে চৌধুরী মশাইকে মান্য করলেও তার কথা না রেখে তার হৃদয়ের কথায় সে শুনেছে। যখন ছিরুপাল তাকে ভরা সভাতে অপমান করতে চাই, তখন্ও তার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে – “এই দেখ ছিরু মোড়ল তুমি একটু হিসেব করে কথা বলবে।” তার এই স্পষ্টবাদী স্বভাবের জন্য সে যেমন উপন্যাসে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে, তেমনি তাকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

◆ যুক্তিবাদী:  অনিরুদ্ধ চরিত্রের মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য সে অত্যন্ত যুক্তিবাদী। সে যা কিছু গ্রহণ করে বা মেনে নেয় তার মধ্যে যদি যুক্তি থাকে তবেই। মজলিশে  যখন চৌধুরী মশাই তাকে গ্রামের না কাজ করার কারণ জানতে চাই, তখন সে শহরে কাজ করার পেছনে যুক্তি দেখায়।‌ ইউরোপের নবজাগরণ ফলে ইউরোপের জিনিস অনেক সস্তায় ভারতে বিক্রি করা হয়, তাই ভারতের মানুষেরা দেশি বহু মূল্যের জিনিস ফেলে রেখে সস্তায় জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ফলে অনিরুদ্ধ কামারের মতো অনেক শ্রমিক মানুষের কাজ কমে যায়, তাই তারা রোজকারের জন্য শহর মুখী হয়। অনিরুদ্ধ তাই তার যুক্তি দিয়ে সভার মানুষদের তা বোঝাতে চাই – “ঘর সংসার যখন করছি তখন ঘরের লোকের মুখে দুটো দিতে হবে। তার ওপর ধরুন, আজকালকার হাল-চাল সেরকম নেই…” এছাড়াও আরও একটি যুক্তি দেখায়, তারা ধানের বিনিময়ে কাজ করে, আর সেই ধানই তারা ঠিক সময় মত পায় না। কেউ ধার রাখে, আবার কেউ বছরের পর বছর বাকি রাখে। এতে তাদের সংসার চালানো খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে।  তারপর যখন অনিরুদ্ধের জমির ধান ছিরুপাল কেটে নিয়ে গেল, তখন ডাক্তার এসে তাকে থানায় ডায়েরি করতে বললে সে জানায় – “কিন্তু মেয়েছেলেকে এজাহার- ফেজাহার দিতে হবে, সেই কথা আমি ভাবছি।” এখানে তার শুধু যুক্তিবাদি মনেরই পরিচয়য় পাওয়া যায় না, তার সাথে আছে বিশ্লেষণী ক্ষমতাও।

পদ্মার স্বামীর কর্তব্যবোধ: অনিরুদ্ধের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার কর্তব্যবোধ।  সে তার স্ত্রী পদ্মার প্রতি অনেক স্নেহশীল ও যত্নবান। সন্তানহীনা পদ্মাকে সে কখনো তার সন্তান না থাকার অপবাদ দেয়নি।  হয়তো রাগের মাথায় সে কখনো পদ্মার গায়ে হাত তুলেছে, কিন্তু পরে আবার ভালোবাসা দিয়ে তাকে বুকে টেনে নিয়েছে।  উপন্যাসের শেষে অনিরুদ্ধার চরিত্রের স্তলন ঘটলে, তার দুর্গার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠলেও, সে তার স্বামীর কর্তব্যবোধ থেকে সরে আসেনি।  তাই পদ্মা যখন মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়ে মূর্ছা যায়, অনিরুদ্ধই ডাক্তার ডাকতে ছোটে।  দেবু যখন তাকে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে, তখন “অনিরুদ্ধ কাঁদিয়া ফেলিল”। এ যেন তার ভালোবাসারই বহি:প্রকাশ।  পদ্মার এই অসুস্থতার জন্য সে ছিরুপালকেই দায়ী করে বলে – “মানুষ, মানুষেই করে দিয়েছে ডাক্তার; তাতে আর এতটুকুন সন্দেহ নাই।…এ রোগ নয়, মানুষের কীর্তি।”

বিদ্রোহী অনিরুদ্ধ: উপন্যাসে অনিরুদ্ধ প্রথম থেকে বিদ্রোহী স্বভাবের।  সে তার চোখের সামনে কোন অন্যায় দেখলে কখনোই সহ্য করে না তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই।  এর জন্য উচ্চ বর্ণের মানুষেরা তাকে ভালো চোখে দেখতে পারে না বিশেষ করে ছিরু পাল। অনিরুদ্ধ গ্রামের নিয়ম লঙ্ঘন করে শহরে দোকান করছে এর জন্য গ্রামের মানুষ তার বিপক্ষে চলে গেছে। এমনকি পদ্মা যখন মন্দিরে পুজো দিতে যায় তখন তার পুজো ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই অনিরুদ্ধ তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছে “বড় লোকের মাথায় আমি ঝাড়ু মারি, বিদ্বেনের মাথায় আমি ঝাড়ু মারি, আমি কোন শালাকে মানিনা, গ্রাহ্যও করি না। দেখি কোন শালা আমার কি করতে পারে।”  এমনকি ছিরুপাল যখন ভরা সভার মধ্যে হ্যান্ডনোটের কথা বলে অপমান করে তখন অনিরুদ্ধ তার সমস্ত টাকা মিটিয়ে দেয়। এখানে তার আত্মসম্মান প্রকাশ পেয়েছে।  তারপর যখন অনিরুদ্ধের জমির ধান শ্রীহরি কেটে নেয় তখন সে তার প্রতিবাদে ডায়েরী করতে যাবার জন্য প্রস্তুত হয় কিন্তু পদ্মার অনুরোধে তার মনোভাব বদলায়। উপন্যাসের শেষে বিদ্রোহী অনিরুদ্ধ ছিরু পালের বাগানবাড়ি বাঁশ কেটে জেলে যায়।
ঔপন্যাসিক উপন্যাসের শেষে চরিত্রটিকে কিছুটা নীচে নামিয়ে এনেছেন, অনিরুদ্ধের চরিত্রের অবনতি ঘটিয়ে। উপন্যাসের অন্তিম পর্বগুলিতে দেখা যায়, সে অত্যন্ত নেশাশক্ত মাতাল হয়ে পড়েছে।  এমনকি পদ্মের মতো স্ত্রীর ভালোবাসা উপেক্ষা করে স্বৈরিনী দুর্গার মোহে মোহিত হয়েছে। তার বাড়ীতে যাতায়াত তো আছেই , সেই সঙ্গে তার বাড়ীতে খাওয়া দাওয়াও করে সে। এখানেই অনিরুদ্ধের চরিত্রের পতন ঘটেছে। যেখানে সে দেবুর চরিত্রকে ছাড়িয়ে উঠতে পারেনি।

অনিরুদ্ধ চরিত্র সম্পর্কে তারাশঙ্করের মতামত:

   

‘গণদেবতা’ উপন্যাসে অনিরুদ্ধের চরিত্রের কথা বলতে গিয়ে শ্রীকুমারবন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন- “শেষ পর্যন্ত সে একটা দুরুহ উন্মাদ, ধ্বংসশক্তির বাহনে পরিণত হ‌ইয়াছে।”

তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে অনিরুদ্ধ কামারকে তিনি খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের প্রতিনিধি করে তুলেছেন। ঔপন্যাসিক এই উপন্যাসে ভেঙে পড়া গণজীবনের সার্বিক চিত্র এঁকেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি, আধুনিক শিল্পায়ন, কর্মহীন মনুষ্য সম্প্রদায়, দারিদ্রতা, বেকারত্ব,  মহামারি,  ম্যালেরিয়া, ঋণের ভার তো ছিল‌ই, সেই সঙ্গে ছিল জমিদার ও মহাজনদের অন্যায়, অত্যাচার, ব্যভিচার ও শোষণ। এর ফলে শোষিত, সর্বহারা শ্রেণীর মানুষদের দেয়ালে পিঠ থেকে যায়, আর তারা হয়ে পড়ে বিদ্রোহী। এই শিবকালীপুরে প্রথম বিদ্রোহের জোয়ার বয়ে এনেছিল অনিরুদ্ধ কামারের প্রতিবাদ। অনিরুদ্ধই প্রথম ব্যক্তিত্ব যে সে নগদ ছাড়া কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলে সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের হাত থেকে তারা রেহাই পেয়েছিল তা হয়নি। বরং তাকে আর‌ও অত্যাচারী ও নিপীড়িত হতে হয়েছিল তৎকালীন উচ্চ শ্রেণীর মানুষ ছিরু পালের হাতে। দেবু ঘোষ যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেও তার বিরুদ্ধে দাঁড়াই শেষে। এর জন্য তার তীব্র রূঢ়তা অনেকাংশেই দায়ী বলে মনে করা হয়। কিন্তু সন্তানহীন অনিরুদ্ধ শেষ পর্যন্ত তলিয়ে গেছে অন্ধকারের গহীন অতলে সে হয়ে পড়েছে নেশাগ্রস্ত, কামাচারী প্রকৃতির।  তার স্ত্রীর পদ্মার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাকে সে দূরে ঠেলে দিয়ে মিলিত হয়েছে দুর্গার সাথে। এমনকি তার চরিত্রের বিদ্রোহীতার যে আগুন তা নিভে এসেছে উপন্যাসের শেষের দিকে। সে কাপুরুষের মতো জেল খাটার ভয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।  উপন্যাসের প্রথমে অনিরুদ্ধের নায়কোচিত ব্যবহার ক্রমেই একজন সাধারণ বিদ্রোহী প্রজাতে পরিণত হয়েছে। দেবু ঘোষের সাহসী উদ্দাম  চরিত্রের পাশে সে হয়ে পড়েছে অত্যন্ত নগণ্য।  তাই নায়কোচিত প্রায় সমস্ত গুন অনিরুদ্ধের থাকলেও সে উপন্যাসের নায়ক হয়ে উঠতে পারেনি। তবে অনিরুদ্ধের চরিত্রের একটা গুন আমাদের চোখে পড়ে,  তার দেখাদেখি নাপিত, লুটনি দাই এবং ধোপা প্রভূতি মানুষকেউ প্রতিবাদী হয়ে উঠতে দেখা যায়।  তারাও অনিরুদ্ধের মতো নগদ ছাড়া কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়, আর এখানেই অনিরুদ্ধের চরিত্রের মহত্ত্ব।

রবীন্দ্রত্তোর বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান উপন্যাসিক হলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর উপন্যাস সম্পর্কে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন –
“…মানুষের যে জীবন অভিজ্ঞতায় ধরা যায়, যার বিকাশ ও পরিণাম কোন দার্শনিক ব্যাখ্যানের অপেক্ষা রাখে না। তারাশঙ্কর নানা পরিবেশে সেই জীবনকেই প্লট ও চরিত্রের মধ্যে উপস্থাপন করেছেন।”

তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে বিচিত্র রূপকল্প শিল্পীর দক্ষতা প্রমাণ করেছেন তাঁর নানা গল্প ও উপন্যাস রচনার মাধ্যমে। তারাশঙ্কর হয়তো আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু তিনি বাংলা কথাসাহিত্যকে নিষ্ফলা করে যাননি। তিনি দিয়ে গেছেন গেছেন গল্প, উপন্যাস ও কবিতার বিচিত্র সম্ভার। সামাজিক,পারিবারিক, মানসিক ও আত্মিক নানা দিক থেকে তার লেখনী ধাবিত হয়েছে। প্রকাশ ভঙ্গিমার নানা বৈচিত্র্য, জীবনকে দেখা ও ফুটিয়ে তোলার কত বিস্ময়কর পন্থার মাধ্যমে তিনি বাংলা উপন্যাসকে নতুন সৃষ্টির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে তিনি যেমন নায়ক ও খলনায়কের বিস্তারিতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি তার পাশাপাশি এক বিদ্রোহী কৃষক প্রজার বিদ্রোহকেও সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। আমরা এখানে দেখতে পায়,  তারাশঙ্করের ঔপন্যাসিক প্রবণতা সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিশ্লেষণের দিকে নয়, এমনকি তাঁর রচিত চরিত্র সেগুলিও যে খুব জটিল, প্রহেলিকাধর্মী, আত্মকেন্দ্রিকতার বৃত্তপথে আবর্তনশীল তাও নয়। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রেরা সকলেই প্রবাহের সঙ্গে এগিয়ে চলে, জীবন প্রতিবেশীর সঙ্গে নিবিড় ভাবে আবদ্ধ এবং সামাজিক ঘাত প্রতিঘাতে ও আদান প্রদানের প্রভাবেই বিকশিত হয়। উপন্যাসে অনিরুদ্ধ চরিত্রকে তিনি বিদ্রোহী শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে তুলেছেন।